Skip to main content

রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার এবং পুনরাবিষ্কার এর পছন্দের কিছু অংশ

 রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক অবস্থানের একটা তুলনা কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে।

দুজনেই ব্রাহ্ম,কিন্তু জীবনানন্দ ব্রাহ্মদের সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে  ফেলছেন।ব্রাহ্মদের ছুঁতমার্গ ও নীতি-কঠোরতা তিনি পছন্দ করতে পারছেন না।ভাগ্যের এমনই পরিহাস,ব্রাহ্ম নীতিবাগীশদের জন্যই তিনি চাকরি হারিয়েছেন এবং অন্য কোনো ভালো চাকরি পাননি।ব্রাহ্ম হলে সেই সময় অনেক সুবিধে পাওয়া যেত,কারন তখন বহু স্কুল কলেজ,শিক্ষা বিভাগে ছিলো ব্রাহ্মদের আধিপত্য। সেই হিসেবে, ইংরেজিতে এম এ পাস করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্রাহ্ম পরিচালিত সিটি কলেজে সহজেই চাকরি পেয়েছিলেন। সেই চাকরি রক্ষা করতে পারলে অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারতেন জীবনানন্দ। গন্ডগোল বাধে সরস্বতী পূজা নিয়ে। বাংলার প্রায় সব স্কুল-কলেজেই সরস্বতী পূজো হয়, সিটি কলেজের অধিকাংশ ছাত্রই হিন্দু, তারাও সরস্বতী পুজো করতে চেয়েছিলো।কলেজ কতৃপক্ষের তাতে  ঘোর আপত্তি। এখনকার সহজ বুদ্ধিতে মনে হয়, ব্রাহ্ম কতৃপক্ষ অতখানি কট্টর না হয়ে যদি ছাত্রদের বুঝিয়ে বলতেন, কলেজ কম্পাউন্ড বাদ দিয়ে একটু বাইরে গিয়ে পূজা করো না বাপু, তা হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।কিন্তু তা হয়নি।কতৃপক্ষ এবং ছাত্ররা জেদ ধরে থাকে।রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের ধিক্কার দিয়ে প্রবন্ধ লেখেন।সুভাষ বসু এসে ছাত্রদের 'বেশ করেছ' বলে যান।অধ্যাপকদের মধ্যে কয়েকজন, জীবনানন্দ সমেত, ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল, এই অভিযোগ উঠে।সেই কয়েকজন অধ্যাপকের চাকরি যায়। কিছু ছাত্রও কলেজ থেকে বিতারিত হয়।পরে আর একবার জীবনানন্দ এই সিটি কলেজেই চাকরির চেষ্টা করেছিলেন, তখন তার কবিতা অশ্লীল, এই ছুতো দেখানো হয়েছিলো।





রবীন্দ্রনাথের বান্ধবী ও অনুরাগিণী ভাগ্য ঈর্ষনীয়।জীবনানন্দের স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় প্রথম থেকেই বনিবনা হয়নি, আর একটি মাত্র  রমনীর প্রতি তাঁর দুর্বলতার প্রমান পাওয়া যায়, তাঁর নামটি এখনো কেউ জানে না, দিনলিপিতে Y অক্ষরে চিহ্নিত।অধরা এই রহস্যময়ী নারী হতভাগ্য কবিটির সঙ্গে কৌতুক করেছেন বলেই মনে হয়।


খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন খুঁতখুঁতে, রুপোর থালা-বাসনে তাঁর অন্ন পরিবেশিত হতো।আর মেসে থাকার সময় জীবনানন্দের আহার বাবদ ব্যয় দৈনিক তিন পয়সা থেকে ছ' পয়সা।


রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন অনেক রকম ব্যবসাও করেছেন,পাট থেকে পশু চামড়া পর্যন্ত। জীবনানন্দও ছাতার বাঁটের  ব্যবসা করবেন ভেবেছিলেন,পারেননি।জীবনবীমার দালাল হতে চেয়েছিলেন, পারেননি।রাস্তায় রাস্তায় খবরের কাগজের হকারি করতেও চেয়েছিলেন।


রবীন্দ্রনাথ ভ্রমনে অক্লান্ত। বিশ্বপর্যটন করেছেন কয়েকবার, বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত। একাত্তর বছর বয়সে পারস্যের শাহেনশাহ-এর আমন্ত্রনে প্লেনে চেপেছেন,তারও পরে একবার অসুস্থ শরীর নিয়েও এলাহাবাদ থেকে মোটরগাড়িতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে যান লাহোরে।আর জীবনানন্দ একেবারেই ঘরকুনো,বাংলা ছেড়ে কোথাও যেতে চান না।আত্মীয়স্বজনরা তাঁর জন্য পাঞ্জাবে কিংবা শিলং এ চাকরি ঠিক করে সেখানে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছেন, বেকার জীবনের অত কষ্ট সত্বেও জীবনানন্দ যাননি।একবার বাধ্য হয়ে দিল্লির এক কলেজে কাজ নিয়েছিলেন,কয়েক মাস পরেই ছুটির সময় পালিয়ে এসে আর ফিরে যাননি।


অন্য কোনো দেশে পা দেননি জীবনানন্দ, কিন্তু তাঁর কবিতায় মিশর থেকে লিবিয়া পর্যন্ত অনেক দেশের নাম পাওয়া যায়। আর পৃথিবীর যে প্রান্তে বসেই লিখুন, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শুধু বাংলার কথা।


তিরিশ বত্রিশ বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ রীতিমতন প্রতিষ্ঠিত, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ,আর এ বয়েসে জীবনানন্দর একখানা কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে,তাও বিশেষ কেউ পাত্তা দেয়নি, পত্র-পত্রিকা থেকে তার কবিতা ফেরত আসে।


এই দুই কবি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর,প্রকৃতপক্ষে এঁদের কোনো তুলনাই চলে না।


~রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার এবং পুনরাবিষ্কার

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়।


Comments

Popular posts from this blog

দীর্ঘশ্বাস -নদীর ধারে।

আমাদের ভেতরে জেগে থাকে একটা দীর্ঘশ্বাস  হৃদয় ঘুমায়ে যায়,জেগে থাকে আমাদের মন কত দিন পরে, কোনো এক শান্ত শীত ভোরে দূর থেকে ভেসে আসে খেজুর পাতার ঘ্রাণ  রংয়ের আকাশে ভেসে মেঘ একটুকু বয়ে নেওয়া রঙিন আবেগ। আমরা ভাবতে থাকি টিনের চালের নিচে শুয়ে কত বাস ট্রাম চলে,আর কত দূর দৌড়ালে  আমাদের কাছে এসে সময় ক্ষমা চেয়ে নেবে আর কত গল্প বলে,কত সব কবিতা লেখা হলে মানুষ ভেবে নেবে সফল জীবন কত দিন, কত সন্ধ্যা পাখির ডাকের থেকে আকাশ দেখে,নিরবে নদীর পারে নদীর ঢেউয়ের সাথে কত কথা বলা হলে পরে আমাদের বন্ধু হবে,আমরা হবো বন্ধু নদী কিংবা ঘাসের  কত দিন কথা হয় ওই নীল পাখিদের সাথে।

চতুরঙ্গ : একটি চৌমুখী পর্যালোচনা!

চতুরঙ্গ উপন্যাসের মূল চরিত্র চারটি। চারটি বিশেষ কাহিনী একত্রিত করেই, একই সুতোর টানে আবর্তিত হয়েছে শ্রীবিলাসের জবানীতে। তারপরও শচীশ না শ্রীবিলাস কাকে প্রধান চরিত্র বলবো তা নিয়ে দ্বন্ধ থেকেই যায়।  জ্যাঠামশাই জগমোহন এর নাস্তিকতার আড়ালে নির্লোভ জন সেবা করা মানবধর্মের সুন্দর পরিচয় বহন করে। জগমোহন থেকে সে মহান গুন পরিচালিত হয়েছে শ্রীবিলাসের দিকে। তৎকালীন সমাজ ব্যাবস্থায় স্রোতের বিপরীতে চলা এরকম চরিত্র সৃষ্টি করা কখনোই সহজ কাজ ছিলো না।নারীজীবননের নানা দ্বন্দ্ব সংঘাত সুচারুরূপে উঠে এসেছে দামিনীর মধ্যে। দামিনীর ভালোবাসা শচীশ আর শ্রীবিলাসের জীবনে নিয়ে এসেছে শীতলতা।যদিও ভালোবাসার স্রোত সর্বদাই শচীশের দিকেই প্রবাহিত হয়েছে। এমনকি শ্রীবিলাসের সাথে বিবাহের পরও সে শচীশের প্রতি নিবেদিতপ্রান। শচীশের জীবিকার চিন্তাও সেই করেছে।কিন্তু মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তে শেষ আকুতিটুকু শ্রীবিলাসের  প্রতিই ছিলো "সাধ মিটিল না, জন্মান্তরে আবার যেন তোমাকে পাই "। দামিনী শক্তভাবে অবহেলা করে গেছে লীলানন্দস্বামীর ধর্ম, কর্ম, প্রেম আর আধ্যাত্মিকতা।  চারটি চরিত্রকে আলাদাভাবে বর্ননা করেও, তাদের স্বকীয়তা ধরে রেখেছেন সমানভা

জাহাজের পটভূমিতে

সকালের কোলাহল শুরু হতে, শুরুর সূর্যের আলো যেইমাত্র জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে তখন আর কে এলিয়ে থাকে গা বিছানার পরে? অতএব, চমৎকার একটা দিনের শুরু শুরু আরো কিছুকাল উদ্দেশ্যেহীন বেচে থাকা কি করে কাটবে এই নিরাশ সময়,সব এলোমেলো ভেবে। ঘর থেকে বের হয়ে একটি পাখিকে ডেকে যেতে দেখি শুধু গাছের আড়ালে তারপর দিন বেড়ে যায়,মানুষের সব  ক্ষুধা গ্রাস করে মৃত অন্ধকার  দুপুরের নিরবতা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন সাগরতীরে ভিড়ে যায় পুরোনো জাহাজ নাবিকেরা নেমে পরে বন্দরের কাছে তাদের ও আছে প্রয়োজন আরো কিছুকাল বেচে উপভোগ করা এই সময়ের স্মৃতি  কত দিন কত রাত পরে,ভিড়ে তারা বন্দরের কাছে। বিকেলের আলোতে বসে চায়ের দোকানে সব কথা ভেবে যায় একটি যুবকে সব অন্ধকার কখন নামবে এই পৃথিবীর বুকে, কখন ফিরবে সব পাখিরা নীড়ে,  কখন উঠবে সব তারাদের দল, অন্ধকার ফুড়ে সব শান্ত চারিদিকে, সব কোলাহল শেষে কখন ফিরবে সব ক্লান্ত দেহ বিছানার পরে।